২০১৮ সালে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে। এ সাফল্যের মধ্য দিয়ে দেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবের সদস্যপদ লাভ করে। স্যাটেলাইটটি দেশের সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ খাতে বিপ্লব ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও, বর্তমানে আর্থিকভাবে সফলতা না পেয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
সেবা বিক্রিতে নকশাগত সমস্যা
স্যাটেলাইট থেকে আর্থিক আয় প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ নকশাগত সমস্যাগুলো। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ট্রান্সপন্ডারগুলো চারটি পৃথক ব্লকে বিভক্ত। প্রতিটি ব্লকে ছয়টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে এবং এক ব্লকের একটি ট্রান্সপন্ডার বিক্রি করা হলে, বাকি পাঁচটি ট্রান্সপন্ডার একই দেশে বিক্রি করতে হয়। এর ফলে অবিক্রীত ট্রান্সপন্ডারের পরিমাণ বেশি থাকে, যা আয় বৃদ্ধি করতে বাধা সৃষ্টি করছে।
লাভ-লোকসানের বিভ্রান্তি
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) সাম্প্রতিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন (২০২১-২২ অর্থবছর) অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই মুনাফার হিসাব থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবচয় বা ডেপ্রিসিয়েশন বাদ দেওয়া হয়েছে। অবচয় গণনা করলে প্রকৃতপক্ষে ৬৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে, ১০ লাখ টাকার একটি সম্পদ ১০ বছরের জন্য ব্যবহারযোগ্য হলে, প্রতিবছর তার ১ লাখ টাকা অবচয় হিসেবে গণ্য করতে হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের স্থায়ী সম্পদমূল্য ধরা হয়েছে ২৭৮৪ কোটি টাকা, এবং এর আয়ুষ্কাল ১৫ বছর। সুতরাং বছরে অবচয় ধরা হয় প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত লাভ-লোকসানের হিসাবকে বদলে দেয়।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের নিরীক্ষা পরিচালনা করেছে এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি। তারা ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, স্যাটেলাইটের সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য বিএসসিএল তাদের সম্পদ বিবরণীতে সঠিকভাবে উল্লেখ করেনি। বিএসসিএল-এর দাবি, বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) এখন পর্যন্ত তাদের কাছে স্যাটেলাইটের সম্পদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ হস্তান্তর করেনি।
এ প্রসঙ্গে এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি আরও বলেছে, স্যাটেলাইটের সম্পদমূল্য সঠিকভাবে না দেখানোয় বিএসসিএলের সম্পদ বিবরণীতে সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। তারা অবচয় বা ডেপ্রিসিয়েশন উল্লেখ না করে মুনাফার হিসাব দেখিয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রতিফলিত করছে না।
অবচয় না দেখানোর প্রভাব
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সম্পদের উপর অবচয় না দেখানোয় বিএসসিএল একটি লাভজনক কোম্পানি হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে। যদিও হিসাববিদদের মতে, অবচয় ধরে হিসাব করলে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত। তাছাড়া, সম্পদ বিবরণীতে স্যাটেলাইটের সম্পদমূল্য সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত না করায় বিএসসিএলের হিসাব তথ্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
ভবিষ্যৎ আয় এবং আর্থিক পরিকল্পনা
বিএসসিএলের বর্তমান আয়ের বেশিরভাগই স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল এবং বিদেশি কিছু চ্যানেলের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি থেকে আসছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আয় ছিল প্রায় ১৩০ কোটি টাকা, যা স্যাটেলাইটের ব্যয়ের তুলনায় কম। স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি বাংলাদেশে এবং ২০টি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করার পরিকল্পনা ছিল, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ট্রান্সপন্ডার বিক্রির প্রচেষ্টা তেমনভাবে সফল হয়নি।
দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের উদ্যোগ
আর্থিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার গ্লাভকসমসের সঙ্গে একটি সহযোগিতা স্মারক সই হয়, তবে প্রকল্পটি দীর্ঘমেয়াদী আয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বর্তমান আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো সত্ত্বেও, এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল হতে পারে যদি কোম্পানিটি সঠিকভাবে আর্থিক পরিচালনা ও বাজার বিস্তৃত করতে পারে।