আফ্রিকার গরিব অবস্থার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ঐতিহাসিক, ভূগোল, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কারণ একত্রে আফ্রিকাকে উন্নয়নশীলতার পেছনে রেখে দিয়েছে। যেসব দেশের ভূমি উর্বর, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং জনগণ শারীরিকভাবে শক্তিশালী, সেই আফ্রিকাকে কেন বিশ্বের গরীবতম অঞ্চলের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়? এই প্রশ্নটি বিভিন্ন গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং ইতিহাসবিদদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। নিচে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হলো।
১. আফ্রিকার ভৌগোলিক অবস্থান
আফ্রিকার ভৌগোলিক গঠন এবং জলবায়ুগত বৈচিত্র্য তাদের উন্নয়নের একটি বড় বাঁধা হিসেবে কাজ করেছে। মহাদেশটি মূলত উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত, যেখানে বিভিন্ন জলবায়ুগত বৈচিত্র্য দেখা যায়। ইউরেশিয়া মহাদেশের মতো পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত না হওয়ায় এখানকার মানুষেরা নিজেদের সংস্কৃতি ও অভ্যাসের মধ্যে সাদৃশ্য রাখতে পারেনি। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একে অপরের সাথে সহজে মিশতে পারেনি এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত থেকেছে।
আবহাওয়া ও ফসল উৎপাদন
আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে যেমন— উত্তরে স্যাহারা মরুভূমি, মধ্যাঞ্চলে তৃণভূমি, এবং দক্ষিণে ট্রপিকাল রেইনফরেস্ট— একেক এলাকায় একেক ধরনের কৃষি উৎপাদন হয়। ইউরোপের মতো আবহাওয়া এখানে একরকম নয়, ফলে এক এলাকায় উৎপাদিত খাদ্য অন্য এলাকায় সহজে স্থানান্তরিত বা ব্যবহার করা যায় না। এর ফলে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করেছে।
২. ঐতিহাসিকভাবে দাস প্রথা ও উপনিবেশবাদ
আফ্রিকার ইতিহাসে দাস প্রথা এবং ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদ দুইটি ভয়াবহ অধ্যায়। ১৫ শতকে ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদীরা আফ্রিকাকে তাদের শোষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিল। আফ্রিকার লাখ লাখ মানুষকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এবং তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করা হয়েছে।
উপনিবেশের প্রভাব
ইউরোপিয়ানরা আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন— সোনা, হীরা, এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদ লুট করে। আফ্রিকার জনগণকে কেবলমাত্র শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো, তারা নিজেদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকতো। ব্রিটিশ, ফরাসি, বেলজিয়ান, এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের উপনিবেশের ফলে আফ্রিকায় শিক্ষা, অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে “ব্লাড ডায়মন্ড” এর মতো সিনেমাগুলোতে দেখানো হয়েছে কীভাবে আফ্রিকার সম্পদ ইউরোপিয়ানদের হাতে চলে যায়, এবং আফ্রিকার মানুষদেরকে নির্দয়ভাবে দাসে পরিণত করা হয়।
৩. গোত্রগত বিভাজন এবং সংঘাত
আফ্রিকার সমাজ ব্যবস্থায় গোত্রগত বিভাজন একটি অন্যতম বড় সমস্যা। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল হাজার হাজার আলাদা আলাদা গোত্রে বিভক্ত ছিল এবং এখনো আছে। উপনিবেশবাদীরা এই বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে আফ্রিকান সমাজকে আরও বেশি দুর্বল করে তোলে। এই বিভাজন আফ্রিকার মানুষদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া কঠিন করে তোলে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে উঠতে বাধা দেয়।
গোত্রগত সংঘাত ও পরিণতি
উপনিবেশের পর আফ্রিকা স্বাধীন হলেও তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এই বিভাজন এবং সংঘাত দেখা দেয়। গোত্রগত সংঘাতের ফলে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নষ্ট হয় এবং প্রায়ই গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, রুয়ান্ডার গণহত্যা বা সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধ এই সংঘাতের কিছু দৃষ্টান্ত।
৪. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতি
আফ্রিকার অনেক দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ব্যাপক দুর্নীতির শিকার। স্বাধীনতা পাওয়ার পর অনেক দেশেই সুশাসনের অভাব এবং দুর্নীতির প্রকোপের কারণে তাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, জিম্বাবুয়ে, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, এবং সিয়েরা লিওনের মতো দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার লোভে সাধারণ মানুষের উন্নয়নের বিষয়ে উদাসীন ছিল।
দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থা
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সম্পদ সাধারণ মানুষের মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টিত হতে পারেনি। সরকারি স্তরে দুর্নীতি এতটাই প্রকট ছিল যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কার্যকর হতে পারেনি, এবং সম্পদ অপব্যবহৃত হয়েছে।
৫. আফ্রিকার সম্ভাবনা: ফিউচার ইজ আফ্রিকা
যদিও আফ্রিকার ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তবুও অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন আফ্রিকা ভবিষ্যতের একটি বড় সুযোগের মহাদেশ। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে— উর্বর কৃষিজমি, বিশাল জনসংখ্যা, এবং প্রাকৃতিক সম্পদ।
কৃষিক্ষেত্রে সম্ভাবনা
আফ্রিকার উর্বর কৃষিজমি আগামী ১০০ বছরে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা এবং পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্টের মতো দেশগুলোর কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটছে।
জনসংখ্যাগত সুবিধা
আফ্রিকার জনসংখ্যার গড় বয়স মাত্র ১৯ বছর, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনা। ২১০০ সালের মধ্যে আফ্রিকার মেগাসিটি গুলোর জনসংখ্যা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল হবে। বিশ্বের বেশিরভাগ মেগাসিটি আফ্রিকাতেই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।