বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলোর (যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, এবং নাগাল্যান্ড) জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই অঞ্চলগুলোর আর্থিক বিকাশের পথ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে।
১. অবকাঠামোগত দুর্বলতা
বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতীয় রাজ্যগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে হয়েছে। রাস্তাঘাট, রেল যোগাযোগ, বন্দর এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো মৌলিক অবকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল এবং নদীর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প স্থাপনের পথে বড় বাধা।
২. শিল্পায়নের ঘাটতি
এই অঞ্চলে ভারী শিল্পের খুব কম উপস্থিতি দেখা যায়। অধিকাংশ রাজ্যে কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি রয়েছে, তবে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে কৃষিখাতের উৎপাদনশীলতা অনেক কম। শিল্পায়নের অভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হারও কম, যা জিডিপির বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিল্প খাতের বিকাশ না হলে রাজ্যগুলো বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকে।
৩. ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ
বাংলাদেশ লাগোয়া অনেক রাজ্য ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার। ব্রিটিশ আমলে ভারতের পূর্বাঞ্চল অনেকটা অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময়েও এই অঞ্চলে খুব বেশি শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়নি। এছাড়া, স্বাধীনতার পরও এই অঞ্চলগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক মনোযোগ দেওয়া হয়নি, যার ফলে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার ধারা অব্যাহত থাকে।
৪. ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিচ্ছিন্নতা
উত্তর-পূর্ব ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ ভূ-রাজনৈতিকভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে, দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু বা চেন্নাইয়ের মতো বড় শহরগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত থাকে। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও কম থাকে এবং রাজ্যগুলোর ব্যবসায়িক পরিবেশও তেমন উন্নত হয়নি।
৫. সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত ও আঞ্চলিক বিরোধের শিকার হয়েছে। এমন বিরোধের ফলে অস্থিরতা এবং সহিংসতা দেখা দেয়, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক উপস্থিতি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কারণে এখানকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
৬. জনসংখ্যার ঘনত্ব ও শিক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতি
এই অঞ্চলের রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়া, দক্ষ জনশক্তির অভাব এবং উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, এবং আধুনিক দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
৭. কৃষি নির্ভরতা এবং জলবায়ুর প্রভাব
বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যগুলোতে অর্থনীতি প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি উৎপাদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলে বন্যা, ভূমিকম্প এবং ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়মিত ঘটে থাকে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
৮. সীমান্ত সমস্যা ও বাণিজ্য বাধা
বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যগুলো আন্তর্জাতিক সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় সীমান্ত নিরাপত্তা, অবৈধ অনুপ্রবেশ, এবং চোরাচালানের মতো সমস্যায় ভোগে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সীমান্তের নানান বিধি-নিষেধ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি।
৯. সুবিধাবঞ্চিত জনসংখ্যা
উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক রাজ্যে আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। এই জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত এবং তাদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত। তাদের উন্নয়নের জন্য বিশেষ কর্মসূচি প্রয়োজন, যা এখনো পর্যাপ্তভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
১০. কেন্দ্রীয় সরকারের অপ্রতুল মনোযোগ
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতি অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অপ্রতুল মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্র সরকার এই অঞ্চলগুলোর উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই এই অঞ্চলের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন হয় না।
বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলোর জিডিপি কম থাকার পেছনে বহুস্তরীয় কারণ রয়েছে। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, এবং শিল্পায়নের অভাবের মতো সমস্যাগুলো এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে এই অঞ্চলের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।