ভারতের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা প্রায়ই বাংলাদেশিদের নিয়ে উস্কানিমূলক এবং অসম্মানজনক মন্তব্য করে থাকেন, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বেড়েছে। তারা বাংলাদেশিদের “উইপোকা” বলে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন বা এমনকি তাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন। এই ধরনের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পরও শেখ হাসিনার সরকার বরাবরই নীরব থেকেছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়নি। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
অমিত শাহের সাম্প্রতিক উস্কানি
বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি হুমকি দেন যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের “উল্টো করে ঝুলিয়ে” শাস্তি দেওয়া হবে। এটি প্রথমবার নয়, এর আগেও তিনি বাংলাদেশি অভিবাসীদের “উইপোকা” বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
শাহের বক্তব্যে বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে। তিনি দাবি করেন যে এই অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খণ্ডে এসে সম্পত্তি দখল করছে, মিথ্যা বিবাহের মাধ্যমে স্থানীয় মেয়েদের প্রতারণা করছে এবং কর্মসংস্থান দখল করছে। শাহ আরও বলেন, যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না করা হয়, তাহলে আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে এই অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে। তিনি ঝাড়খণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে তারা এই অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষা করছে, কারণ তারা তাদের ভোটব্যাংকের অংশ।
শাহের বার্তা ছিল স্পষ্ট: “এখানে বিজেপির সরকার গঠন করুন, আমরা এই অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে ঠিক করব।”
বাংলাদেশিদের টার্গেট করার পেছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বিজেপির বাংলাদেশিদের টার্গেট করার কৌশলটি তাদের বৃহত্তর রাজনৈতিক আখ্যানের অংশ, যা হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের মতে, বাংলাদেশিদের প্রতি বিজেপির আক্রমণাত্মক বক্তব্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের পূর্ববর্তী অবস্থানের প্রতিফলন। হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর জন্য, মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরেই “অন্য” বা বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে এই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল, তবে সাম্প্রতিক দশকে বাংলাদেশও একটি সুবিধাজনক লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
বিজেপি পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশি অভিবাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মতো রাজ্যে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হচ্ছে, এবং সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশাতেও এই কৌশল প্রসারিত হয়েছে। ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন যে, এই প্রচারের ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং দিল্লির আশেপাশের অঞ্চলে তারা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি ওড়িশাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
নির্বাচনী কৌশল: ভোটারদের মেরুকরণ
কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলেন, এই ধরনের মন্তব্যগুলি প্রায়শই বিজেপির সমর্থকদের একত্রিত করার জন্য, বিশেষত নির্বাচনের সময়ে করা হয়। বিজেপি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ইস্যু ব্যবহার করে ভোটারদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চায়, বিশেষ করে হিন্দু ভোটারদের মধ্যে যাদের মধ্যে মুসলমানদের নিয়ে ভয় এবং সন্দেহ আছে। এই কৌশলটি “আমরা বনাম তারা” ধরনের আখ্যান গড়ে তোলে, যেখানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়।
বিজেপির এই কৌশল শুধুমাত্র সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি ভারতের বিভিন্ন অংশে প্রসারিত হয়েছে, যা অভিবাসন ইস্যুটিকে জাতীয় স্তরে তুলে ধরার একটি প্রয়াস। কর্মসংস্থান, জনসংখ্যার পরিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক পতনের বিষয়ে ভয় জাগিয়ে বিজেপি নিজেদেরকে হিন্দু সভ্যতার রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন
বহু বছর ধরে, শেখ হাসিনার সরকার এই ধরনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত ছিল, এমনকি যখন তা কূটনৈতিক সীমা অতিক্রম করত। তবে, সম্প্রতি অমিত শাহের মন্তব্যের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমবারের মতো শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ঢাকায় ভারতের উপ-রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে শাহের মন্তব্যের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এমন আপত্তিকর মন্তব্য দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করে।
নজিরবিহীন প্রতিবাদ
এই কূটনৈতিক প্রতিবাদটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ কোনো উচ্চপদস্থ ভারতীয় কর্মকর্তার মন্তব্যের বিরুদ্ধে এমন শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। এর আগে, এমনকি বিজেপি নেতারা যখন বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছিলেন, তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ আসেনি, সম্ভবত দুই দেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে।
তবে সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরীর মতে, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত এই বার্তাটি দিতে চাইছে যে তারা আর ভারতের প্রভাবের অধীনে থাকতে রাজি নয়। শাহের মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে, অন্তর্বর্তী সরকার তার স্বাধীনতা ঘোষণা করছে এবং দেখাচ্ছে যে তারা তাদের নাগরিকদের সম্মান রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এই পরিবর্তনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই জটিল এবং সংবেদনশীল। দুই দেশ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে জড়িত থাকলেও, তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রায়শই অভিবাসন, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং পানির বণ্টনের মতো বিষয়গুলোতে উত্তপ্ত হয়েছে।
বৃহত্তর পরিণতি
ভারতে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে চলমান উস্কানিমূলক বক্তব্য দুই দেশের জন্যই দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি বয়ে আনতে পারে। ভারতের জন্য, এটি দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও গভীর করে এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও হয়রানি বাড়ায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জন্য, এটি তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের আরও জটিলতা সৃষ্টি করে এবং ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রতিবাদ একটি আরও শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতির সূচনা করতে পারে, বিশেষত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। ভারত কীভাবে এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা দেখতে হবে, বিশেষ করে বিজেপি যদি তাদের নির্বাচনী কৌশল হিসেবে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য চালিয়ে যায়।
বিজেপি নেতাদের বাংলাদেশিদের টার্গেট করা তাদের বৃহত্তর রাজনৈতিক এবং আদর্শিক কৌশলের অংশ, যা হিন্দু ভোটারদের একত্রিত করার জন্য মুসলমান, বিশেষত বাংলাদেশি অভিবাসীদের হুমকি হিসেবে তুলে ধরে। যদিও এই বক্তব্য বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে কার্যকর হতে পারে, এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সরকার এখন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে তারা তাদের নাগরিকদের সম্মানহানি সহ্য করবে না এবং দুই দেশের সম্পর্ককে আরও সমতা ভিত্তিক করার দিকে এগোচ্ছে।