গত ১০ বছরে ভারতের ঋণ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দেশীয় এবং বৈদেশিক উভয় ঋণ। ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ভারতের মোট ঋণ প্রায় ₹৫০ ট্রিলিয়ন থেকে বেড়ে ₹১৫০ ট্রিলিয়ন হয়েছে। ঋণের এই নাটকীয় বৃদ্ধি দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ উভয়ই তুলে ধরে।
যদিও ঋণের এই বৃদ্ধির ফলে ভারত অবকাঠামো প্রকল্প, সামাজিক কল্যাণ প্রকল্প এবং কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে অর্থনৈতিক প্রণোদনা অর্থায়নে সক্ষম হয়েছে, তবে এটি আর্থিক স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা সম্পর্কে উদ্বেগও বাড়িয়েছে।
ভারতের ঋণের বৃদ্ধির সাধারণ চিত্র
ভারতের মোট ঋণ মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত: দেশীয় ঋণ এবং বৈদেশিক ঋণ। দেশীয় ঋণই মোট ঋণের বেশিরভাগ অংশের জন্য দায়ী, তবে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে নেওয়া বৈদেশিক ঋণও দেশের আর্থিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
২০১৪ সালে, ভারতের মোট ঋণ প্রায় ₹৫০ ট্রিলিয়ন ছিল, যার মধ্যে সরকারি ঋণ একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তবে, ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ঋণ প্রায় ₹১৫০ ট্রিলিয়নে পৌঁছেছে, যা সরকারের ঋণগ্রহণ, কর্পোরেট ঋণ এবং বৈদেশিক অর্থায়নের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণে।
এই ঋণ বৃদ্ধির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হল:
- সরকারি ঋণগ্রহণ: অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা এবং সামাজিক প্রকল্পগুলোর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো ঋণগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে।
- বৈদেশিক ঋণ: ভারতের বৈদেশিক ঋণ ২০২৪ সালের মার্চ মাসে $৬৬৩.৮ বিলিয়ন পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় $৩৯.৭ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।
- মহামারী-চালিত প্রণোদনা: কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সরকার বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন করে, যার ফলে ঋণের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
- বেসরকারি খাতের ঋণ: ভারতের কর্পোরেট খাত ক্রমবর্ধমান হারে বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীল, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঋণ বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলো
গত দশকে ভারতের ঋণ বৃদ্ধির পিছনে বিভিন্ন কাঠামোগত এবং নীতিগত কারণ রয়েছে।
- অবকাঠামো ব্যয়ে বৃদ্ধি: সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নে ফোকাস দেওয়ার ফলে ঋণগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতমালা, সাগরমালা এবং স্মার্ট সিটি প্রকল্পগুলো বড় অর্থায়নের প্রয়োজন, যার কারণে ঋণগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
- রাজস্ব ঘাটতি: ভারতের রাজস্ব ঘাটতি — যা সরকারের ব্যয় এবং আয়ের মধ্যে পার্থক্য — বছরের পর বছর ধরে বেড়েছে। মহামারীর সময় এটি ৯.৫% পর্যন্ত পৌঁছেছিল এবং তারপরে ৬% এর উপরে ছিল। এই ফাঁক পূরণ করতে সরকার দেশীয় এবং বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভর করছে।
- মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বৈশ্বিক সুদের হার: ভারতীয় রুপির অবমূল্যায়নের ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার খরচ বেড়েছে। এছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলিতে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে ভারতের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণগ্রহণের খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে।
- কোভিড-১৯ মহামারী: মহামারী ভারতের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার বড় অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করে, যার ফলে সরকারি ঋণ বেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এবং বেকারত্ব সহায়তার প্রয়োজনীয়তাও ঋণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
ভারতের ঋণ বৃদ্ধির প্রভাব এবং উদ্বেগ
যদিও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য ঋণ প্রয়োজনীয়, গত দশকে ভারতের ঋণের তিনগুণ বৃদ্ধির ফলে বেশ কয়েকটি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
- ঋণের স্থায়িত্ব: ভারতের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৮৫% ছাড়িয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিচালনা করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। উচ্চ ঋণের স্তর সুদের পরিশোধের বোঝা বাড়ায়, যা শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় সীমিত করে দেয়।
- মুদ্রাস্ফীতি: সরকারের ঋণগ্রহণ বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যখন এটি মুদ্রা ছাপানো বা সরকারি ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়। কোভিড-১৯ পরবর্তী বছরে সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যাঘাত এবং জ্বালানির খরচ বৃদ্ধি ইতিমধ্যেই ভারতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ তৈরি করেছে।
- বৈদেশিক ঋণ পরিষেবা: $৬৬৩.৮ বিলিয়ন বৈদেশিক ঋণের কারণে রুপির অবমূল্যায়ন এবং বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা ভারতের বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার ক্ষমতা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। দুর্বল রুপি বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়িয়ে দেয়।
- ক্রেডিট রেটিং এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা: উচ্চ ঋণ-জিডিপি অনুপাত দেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিতে পারে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। ক্রেডিট রেটিং কমে গেলে সরকারের এবং ভারতের কোম্পানিগুলোর ঋণগ্রহণের খরচ বৃদ্ধি পাবে।
সুযোগ এবং আগামীর পথচলা
ঋণের বৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ হলেও এটি ভারতকে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান তৈরি এবং অবকাঠামো উন্নত করতে সহায়তা করেছে। ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ঋণ ব্যবস্থাপনায় সহায়ক হতে পারে।
- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সমাধান হিসেবে: যদি ভারত উচ্চ জিডিপি বৃদ্ধির হার (৭-৮%) বজায় রাখতে পারে, তবে ঋণের বৃদ্ধি বজায় রাখা সম্ভব। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সরকারের রাজস্ব বাড়াবে, যা ঋণ পরিশোধে সহায়ক হবে।
- ঋণ ব্যবস্থাপনা সংস্কার: ঋণ স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে ভারতের সরকারকে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে কর সংগ্রহের উন্নতি, অ-প্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো এবং ভর্তুকি হ্রাস করা অন্তর্ভুক্ত। ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন (এনএমপি) চালু করে সরকার সরকারি সম্পদ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের একটি ধাপ এগিয়েছে।
- রপ্তানির উপর গুরুত্ব: বৈদেশিক ঋণ পরিচালনার জন্য ভারতকে রপ্তানি বাড়ানো এবং আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে। ফার্মাসিউটিক্যাল, আইটি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মতো খাতগুলিকে উন্নীত করে ভারত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।
- রাজস্ব দায়িত্ব: সরকারকে রাজস্ব দায়িত্ব এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন (FRBM) এর লক্ষ্যগুলির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, যা আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ঘাটতি এবং ঋণ সীমা নির্ধারণ করে।
উপসংহার
ভারতের ঋণ, যা গত দশকে তিনগুণ বেড়েছে, দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং জটিল চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন ঘটায়। ঋণ বৃদ্ধির ফলে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে, তবে এই ঋণ টেকসই রাখতে সক্ষম আর্থিক ব্যবস্থাপনা, কাঠামোগত সংস্কার এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ঋণগ্রহণ এবং পরিশোধের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই ভারতের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হবে।