জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে নানা ষড়যন্ত্র ও তত্ত্ব উঠে আসলেও, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বা অন্য কোনো দেশের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণিত তথ্যের অভাব রয়েছে। তবে এই ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনীতি, সামরিক অভ্যুত্থান এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করতে হলে বেশ কিছু দিক থেকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উঠে আসেন এবং ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন।
জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে তার শক্ত অবস্থান এবং তার নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের শাসনব্যবস্থা দৃঢ় করেন। তবে তার শাসনামলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে টানাপোড়েন এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাপে তার শাসনাবস্থাকে জটিল করে তোলে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের এক সামরিক ঘাঁটিতে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকাণ্ডটি ঘটে যখন তিনি চট্টগ্রামে একটি রাজনৈতিক সফরে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রাথমিকভাবে কাদের নেতৃত্বে তা ঘটেছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ধারণা করা হয়, সেনাবাহিনীর একটি অংশ তার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
কিছু গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, এটি ছিল এক ধরনের অভ্যন্তরীণ সামরিক অভ্যুত্থান। তাদের মতে, সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং জিয়াউর রহমানের নীতির প্রতি সেনাবাহিনীর একটি অংশের অসন্তোষই এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ।
আন্তর্জাতিক তত্ত্ব ও ষড়যন্ত্র
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সময়ে সময়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উঠে এসেছে। একটি সাধারণ তত্ত্ব হলো যে, তার হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক শক্তির হাত ছিল। কিছু মানুষ মনে করেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রভাব সবসময়ই ছিল এবং বিশেষত পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
তবে এই প্রেক্ষাপটে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” (Research and Analysis Wing) বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনেকেই মনে করেন যে, এ ধরনের তত্ত্বগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দোষারোপ করতে তৈরি করা হয়েছে এবং এদের পেছনে প্রকৃত সত্যতা নেই।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ও রাজনৈতিক অবস্থান
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মিশ্র। তিনি একদিকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে সুসংহত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তবে অন্যদিকে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক পুনর্গঠন করেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চেয়েছিল এবং ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল।
এই কারণে, কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন যে, ভারতের কিছু মহল তার হত্যাকাণ্ডে খুশি ছিল, কারণ তার নেতৃত্বের সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন কূটনীতি পরিচালনা করছিল, যা ভারতের সঙ্গে সবসময় সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তবে এটি একটি তত্ত্ব, যার পক্ষে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই।
র’ এর ভূমিকা: প্রকৃত প্রেক্ষাপট
র’ (Research and Analysis Wing) ভারতের প্রধান বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা। এই সংস্থার মূল কাজ ভারতের নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করা, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। কিছু লোক বিশ্বাস করেন যে, র’ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সামরিক অভ্যুত্থানে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তবে এটি প্রমাণিত নয়।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র’ এর জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে যে তত্ত্বগুলো উঠে এসেছে, সেগুলোর কোনো সুসংহত বা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। অনেক সময় এ ধরনের তত্ত্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হয়, যা প্রমাণিত তথ্যের চেয়ে অনুমানের ওপর বেশি ভিত্তি করে। র’ এর উদ্দেশ্য বরাবরই ছিল ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ বজায় রাখা, কিন্তু বাংলাদেশে সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই।
হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী প্রভাব
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। তার মৃত্যুর পর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ীভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, কিন্তু কিছুদিন পরই হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে একটি নতুন সামরিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা প্রায় এক দশক ধরে চলে।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী, বেগম খালেদা জিয়া, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হন। এই হত্যাকাণ্ড বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধকে আরও তীব্র করে তোলে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজও গভীর প্রভাব ফেলে আসছে।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে এক রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটের সময়ে ঘটে, এবং এ বিষয়ে অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে। যদিও অনেকেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন, প্রমাণের অভাবে এটি একটি অনুমান মাত্র। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটই তার মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়।




