ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থান এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়, তবে এটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগের কারণও তৈরি হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক এবং সমালোচক বিজেপির উত্থানকে ভারতের বহুত্ববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য বিপদজনক হিসেবে দেখছেন। ভারতের জন্য বিজেপির উত্থান কেন বিপদজনক হতে পারে, তা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:
১. ধর্মীয় মেরুকরণ এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা
১.১ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার
বিজেপির রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো হিন্দুত্ববাদ, যা হিন্দু ধর্মের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের সংবিধান বহুত্ববাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দেয়, যেখানে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার ও স্বাধীনতা থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিজেপির ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এই নীতি থেকে বিচ্যুতির দিকে ধাবিত করে। এর ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি হতে পারে।
১.২ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং সহিংসতা
বিজেপির উত্থানের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গরু রক্ষার নামে লিঞ্চিং এবং মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এর উদাহরণ। সমালোচকরা বলছেন, বিজেপি শাসনামলে এই ধরনের সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে পারে, যা ভারতের সামাজিক ঐক্য এবং স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
২. বহুত্ববাদী সমাজের জন্য হুমকি
২.১ ধর্মনিরপেক্ষতার বিপন্নতা
ভারত একটি বহু-ধর্মীয়, বহু-সাংস্কৃতিক দেশ, যেখানে নানা ধর্ম, ভাষা, এবং সংস্কৃতি সহাবস্থান করছে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভারতীয় সমাজের এই বহুত্ববাদী চরিত্রের বিপরীতে অবস্থান করছে বলে সমালোচকরা মনে করেন। বিজেপির অনেক নেতার বক্তব্য এবং পদক্ষেপ ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পরিপন্থী।
২.২ সংখ্যালঘুদের অধিকার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা
বিজেপি শাসনামলে মুসলিম, খ্রিস্টান, এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) নিয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলি সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি করেছে। সমালোচকরা মনে করেন, এই ধরনের আইনগুলি ভারতের বহুত্ববাদী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
৩. বাক স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের সংকট
৩.১ মিডিয়া এবং বিচারব্যবস্থার উপর চাপ
বিজেপির উত্থানের পর থেকে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচকরা মনে করেন, মিডিয়া এবং বিচার বিভাগে সরকারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বিপদজনক হতে পারে।
৩.২ বিরোধী মতকে দমন
বিজেপির শাসনামলে বিরোধী মতকে দমন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের সমালোচনা করার জন্য সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং বিরোধী নেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। এই ধরনের পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
৪. সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং ভোটব্যাংকের রাজনীতি
৪.১ নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার
বিজেপি প্রায়শই নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণকে কাজে লাগিয়ে ভোটব্যাংক তৈরি করেছে। হিন্দু ভোটকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সংখ্যালঘুদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং প্রচারণা চালানো হয়েছে। এই ধরনের রাজনীতি ভারতীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এটি সামাজিক বিভাজনকে বাড়িয়ে তোলে।
৪.২ সামাজিক দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা
বিজেপির ধর্মভিত্তিক এবং জাতিগত বিভাজনের রাজনীতি দেশের ভেতরে সামাজিক দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা তৈরি করে। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি, দলিত ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য, এবং উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ সংঘাত সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
৫. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য হুমকি
৫.১ মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনতি
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং মুসলিমবিরোধী ভাবমূর্তি ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষত মুসলিম দেশগুলোর সাথে। ভারত সবসময় মুসলিম দেশগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে, কিন্তু বিজেপির সময়ে এই সম্পর্ক কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিজেপির নীতি ও কর্মকাণ্ডের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, যা কূটনৈতিকভাবে ভারতের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
৫.২ আন্তর্জাতিক সমালোচনা
ভারতে বিজেপির শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও সমালোচনা বেড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যা ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
উপসংহার
বিজেপির উত্থান ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক জীবনে এক বড় পরিবর্তন এনেছে। যদিও বিজেপির অনেক নীতি এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তাদের সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তবে এর সমালোচকদের মতে, বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ, এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সংকুচিত করার প্রবণতা ভারতের বহুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য বিপদজনক হতে পারে। ভারতের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র, সামাজিক শান্তি, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাংবিধানিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী রাখা অত্যন্ত জরুরি।