ভারতের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, এবং নাগাল্যান্ড বাংলাদেশের সাথে সীমানা ভাগ করে নেয়। তবে, এ রাজ্যগুলোর পার ক্যাপিটা আয় তুলনামূলকভাবে ভারতের অন্যান্য উন্নত রাজ্যগুলোর চেয়ে কম। যেখানে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের পার ক্যাপিটা আয় প্রায় ২,৭৯৩ ডলার, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, এবং অন্যান্য রাজ্যগুলোর পার ক্যাপিটা আয় বেশ কম।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই রাজ্যগুলোর পার ক্যাপিটা আয় নিম্নরূপ:
- পশ্চিমবঙ্গ: ₹1,24,798 (প্রায় $1,643)(Chegg India)
- আসাম: ₹1,02,965 (প্রায় $1,356)(Chegg India)
- ত্রিপুরা: ₹1,37,472 (প্রায় $1,810)(Chegg India)
- মেঘালয়: ₹1,03,335 (প্রায় $1,360)(Chegg India)
- মিজোরাম: ₹1,98,962 (প্রায় $2,619)(Chegg India)
- মণিপুর: ₹91,560 (প্রায় $1,205)(Chegg India)
- নাগাল্যান্ড: ₹1,25,887 (প্রায় $1,657)(Chegg India)
এই বৈষম্যের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ও ভৌগোলিক কারণ।
এই প্রবন্ধে আমরা এই রাজ্যগুলোর পার ক্যাপিটা আয় কেন কম তা বিশ্লেষণ করবো, এবং ভারতের বৃহত্তর অর্থনৈতিক কাঠামোতে এই সমস্যার কারণগুলো বুঝতে চেষ্টা করবো।
১. ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলো মূলত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং দুর্গম অঞ্চল নিয়ে গঠিত। বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারত, যেখানে আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যগুলো অবস্থিত। এ অঞ্চলগুলো পাহাড়ি এবং বনাঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত, যা অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা। রাস্তা, রেলপথ, এবং অন্যান্য পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তোলা এই দুর্গম এলাকায় অত্যন্ত কঠিন। ফলস্বরূপ, শিল্পায়ন এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বিকাশ সীমিত থাকে, যা অর্থনীতির স্থবিরতা ঘটায় এবং পার ক্যাপিটা আয় কম থাকে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে প্রায়ই বন্যা, ভূমিধস, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। আসাম রাজ্য যেমন প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র নদীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো নিয়মিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করে এবং রাজ্যগুলোর উন্নয়নশীলতা ক্ষুণ্ন করে।
২. শিল্পায়নের অভাব ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের বাংলাদেশের লাগোয়া রাজ্যগুলোর অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডের অর্থনীতিতে কৃষি প্রধান খাত। যদিও কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত, এটি ভারতের অন্যান্য শিল্পসমৃদ্ধ রাজ্যগুলোর তুলনায় ততটা লাভজনক নয়। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর প্রধানত চা, ধান, আনারস, এবং অন্যান্য ফসলের উৎপাদন হয়। তবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও পদ্ধতির অভাব, অপর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা, এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার দুর্বলতার কারণে এই রাজ্যগুলোতে কৃষির উৎপাদনশীলতা কম থাকে।
শিল্প ও উৎপাদন খাতের অভাব রাজ্যগুলোর অর্থনীতিকে একপেশে করে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, আসামে চা শিল্পের বাইরে অন্যান্য শিল্প কার্যক্রম খুবই সীমিত। একইভাবে, ত্রিপুরা ও মিজোরামের মতো রাজ্যগুলোতে শিল্পায়নের অভাব রয়েছে। এ কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত এবং রাজ্যগুলোর মানুষের আয় কম।
৩. সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে। মণিপুর, নাগাল্যান্ড, এবং আসামের মতো রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং উপজাতিদের মধ্যে সংঘাত, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা রাজ্যের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করেছে। এই অস্থিরতা বিনিয়োগের পথে বড় অন্তরায়। যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, সেখানে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চায় না। এর ফলে, এ অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বড় ব্যবসা গড়ে উঠতে পারে না, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
রাজ্যগুলোর প্রশাসনিক দুর্বলতাও একটি কারণ। বিভিন্ন প্রকল্প এবং সরকারি পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি দুর্নীতি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা আরেকটি বড় কারণ।
৪. পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ দুর্বল। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সংযোগ অত্যন্ত সীমিত। ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত এই রাজ্যগুলোকে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একটি মাত্র স্থলপথ রয়েছে, যেটি সিলিগুড়ি করিডোর (চিকেন নেক) নামে পরিচিত। এই সংকীর্ণ পথ দিয়ে রেল, সড়ক, এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। তবে এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখনও যথেষ্ট হয়নি।
যোগাযোগ ব্যবস্থার এই সীমাবদ্ধতা অর্থনীতির সব খাতকে বাধাগ্রস্ত করে। পণ্য পরিবহন ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়, ফলে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা কঠিন হয়ে পড়ে। রাজ্যগুলোর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও এই যোগাযোগ সংকট প্রভাব ফেলে।
৫. শিক্ষার অভাব এবং দক্ষতা উন্নয়নের ঘাটতি
ভারতের এই সীমানা সংলগ্ন রাজ্যগুলোর মানুষের শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষত দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। আধুনিক শিল্পে কাজ করতে হলে প্রযুক্তি ও দক্ষতার প্রয়োজন, যা এখানকার জনগণের মধ্যে কম। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য রাজ্যগুলোতে উচ্চশিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নের অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে কম। ফলস্বরূপ, এখানকার মানুষ উন্নত বেতনের চাকরি বা ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।
শিক্ষার অভাবের পাশাপাশি দক্ষতার অভাবও বেকারত্বের হার বাড়ায়। এই রাজ্যগুলিতে শিক্ষিত যুবকদের জন্য উচ্চ মানের কর্মসংস্থান খুবই সীমিত। এর ফলে মেধা পাচার ঘটে, এবং অনেকেই কাজের সন্ধানে দেশের অন্য রাজ্য বা দেশের বাইরে চলে যায়।
৬. বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সীমাবদ্ধতা
পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ এবং আসামের চা শিল্প ছাড়া এই অঞ্চলগুলোতে বড় ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান বা বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ খুবই সীমিত। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে চায় না। তাছাড়া বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও নানা প্রকার প্রশাসনিক জটিলতা এবং নিয়ন্ত্রনমূলক বাধা রয়েছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও বাংলাদেশের সীমান্ত বাণিজ্যও তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। যদিও ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে, তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, এবং নাগাল্যান্ডের পার ক্যাপিটা আয় কম হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিল্পায়নের অভাব, অবকাঠামোর দুর্বলতা, এবং শিক্ষার ঘাটতি এগুলোর অন্যতম কারণ। এসব সমস্যার সমাধান এবং উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব।