ত্রিপুরা এবং কুমিল্লা একসময় একই ভূখণ্ডের অংশ ছিল, বিশেষত ব্রিটিশ শাসনকালে। তবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর কুমিল্লা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, আর ত্রিপুরা ভারতের অংশ হিসেবে রয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে, সময়ের সাথে সাথে দুটি অঞ্চল আলাদা পথে এগিয়েছে এবং ত্রিপুরার তুলনায় কুমিল্লা তথা বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। ত্রিপুরার পিছিয়ে পড়ার কারণগুলি বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন।
১. ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যার প্রভাব
১.১ ত্রিপুরার ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জ
ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট রাজ্য, যা মূলত পার্বত্য ও বনভূমি দ্বারা বেষ্টিত। ত্রিপুরার বিচ্ছিন্ন ভৌগোলিক অবস্থান এবং সীমিত স্থলপথের কারণে এটি ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ত্রিপুরা চারদিকে বাংলাদেশ দ্বারা ঘেরা, এবং কেবল একটি ছোট করিডোরের মাধ্যমে এটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত।
এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ত্রিপুরার অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। শিল্প স্থাপন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুব ধীর গতিতে হয়েছে, এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সেই তুলনায় কম হয়েছে। অন্যদিকে, কুমিল্লা বাংলাদেশের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেলা হওয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে।
১.২ কুমিল্লার জনসংখ্যা এবং নগরায়ন
বাংলাদেশের কুমিল্লা একটি ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে মানুষের সংখ্যা বেশি এবং শিল্পায়ন দ্রুততর হয়েছে। কুমিল্লা দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়েছে এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগ থাকার কারণে এটি সহজেই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ত্রিপুরার তুলনায় কুমিল্লা জনসংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে, এবং জনবহুল এলাকা হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এখানে অনেক বেশি সক্রিয়।
২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা
২.১ ত্রিপুরার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, বিশেষ করে সশস্ত্র উপজাতীয় বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের কারণে। ১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন উপজাতীয় সংগঠনের বিদ্রোহ রাজ্যের উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও পরে সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, কিন্তু ত্রিপুরার অবকাঠামো ও শিল্প খাতে সেই উন্নতি দেখা যায়নি যা বাংলাদেশ বা কুমিল্লায় ঘটেছে।
২.২ কুমিল্লা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কয়েক দশকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশটির দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষত, সরকার শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে, যার সুফল কুমিল্লার মতো জেলা সরাসরি পেয়েছে। কুমিল্লায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দ্রুততর হয়েছে, যা ত্রিপুরার তুলনায় অনেক এগিয়ে দিয়েছে।
৩. অর্থনৈতিক ও শিল্প খাতের উন্নয়ন
৩.১ ত্রিপুরার শিল্পায়নের ধীর গতি
ত্রিপুরায় শিল্পায়ন খুব ধীর গতিতে হয়েছে। যদিও কৃষি ত্রিপুরার অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি, তবে শিল্প খাতে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ছোট আকারের শিল্প ও হস্তশিল্পের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি ত্রিপুরাকে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি। এছাড়া ভৌগোলিক দূরত্ব এবং দুর্বল অবকাঠামোও বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
৩.২ কুমিল্লার শিল্প উন্নয়ন
অন্যদিকে, কুমিল্লা একটি শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প, সিরামিক, এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাত কুমিল্লায় দ্রুত বিকশিত হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগ থাকার কারণে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কুমিল্লা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাব হিসেবে গড়ে উঠেছে। সরকারের সঠিক পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ আকর্ষণকারী নীতি কুমিল্লাকে দ্রুত বিকাশ লাভ করতে সহায়তা করেছে।
৪. পরিকাঠামোগত উন্নয়ন
৪.১ ত্রিপুরার অবকাঠামো চ্যালেঞ্জ
ত্রিপুরার অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখনও সীমিত। সড়ক, রেল এবং বিমান সংযোগের ক্ষেত্রে সীমিত উন্নয়নের কারণে ত্রিপুরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ত্রিপুরায় উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, এবং এটি রাজ্যের বাণিজ্যিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
৪.২ কুমিল্লার পরিকাঠামো উন্নয়ন
কুমিল্লা দ্রুতগতিতে তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়েছে। সড়ক, রেল, এবং সেতু নির্মাণে কুমিল্লা বাংলাদেশ সরকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষত কুমিল্লা-সিলেট, ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কের উন্নতি এবং রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
৫. সামাজিক ও শিক্ষা খাতে অগ্রগতি
৫.১ ত্রিপুরার সামাজিক উন্নয়ন
ত্রিপুরায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি দেখা গেলেও, তা এখনও অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের তুলনায় কম। শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও, উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে সুযোগ সীমিত। স্বাস্থ্যখাতেও উন্নত চিকিৎসার জন্য এখনও অনেক সময় রাজ্যের বাইরের শহরে যেতে হয়।
৫.২ কুমিল্লার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন
কুমিল্লায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কুমিল্লা বোর্ড বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বোর্ড এবং এখানকার শিক্ষার্থীদের সাফল্যের হার উচ্চ। এছাড়া কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে।
উপসংহার
ত্রিপুরা এবং কুমিল্লা একসময় একই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অংশ ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আলাদা পথে চলার কারণে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য গড়ে উঠেছে। কুমিল্লা বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে একটি প্রধান বাণিজ্যিক ও শিল্পকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়েছে, যেখানে ত্রিপুরা এখনও ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে পিছিয়ে রয়েছে। ত্রিপুরার অগ্রগতির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্প স্থাপন, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।