ভারত এবং চীন, এশিয়ার দুটি প্রধান পরাশক্তি, দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। উভয় দেশই নিজেদের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করতে এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে চলেছে। তবে, প্রশ্ন হচ্ছে: যুদ্ধের শক্তিতে কে এগিয়ে থাকবে—ভারত নাকি চীন?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের উভয় দেশের সামরিক শক্তি, অস্ত্রের পরিমাণ, প্রতিরক্ষা বাজেট এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিশ্লেষণ করতে হবে।
১. সামরিক বাজেট এবং বাহিনী
চীন সামরিক বাজেট এবং বাহিনীর আকারের দিক থেকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। চীনের সামরিক বাজেট ২০২৩ সালে প্রায় ২২৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারতের বাজেট প্রায় ৭৩ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে চীন তাদের সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তিগত উন্নতিতে ভারত থেকে অনেক এগিয়ে আছে।
চীনের সেনাবাহিনী, পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA), প্রায় ২০ লাখ সক্রিয় সৈন্য নিয়ে গঠিত, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সেনাবাহিনী। অন্যদিকে, ভারতের সেনাবাহিনীতে প্রায় ১৪ লাখ সক্রিয় সৈন্য রয়েছে। যদিও ভারতীয় বাহিনী সংখ্যায় কম, তবে তাদের প্রশিক্ষণ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দক্ষতাও সমানভাবে উন্নত।
২. পারমাণবিক ক্ষমতা
ভারত এবং চীন উভয় দেশেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, তবে চীন পারমাণবিক শক্তির দিক থেকে কিছুটা এগিয়ে। চীনের পারমাণবিক ওয়ারহেড সংখ্যা আনুমানিক ৩৫০, যেখানে ভারতের রয়েছে প্রায় ১৬০ থেকে ১৭০। চীন তাদের পারমাণবিক অস্ত্রগুলিকে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের মাধ্যমে ছোড়ার ক্ষমতা রাখে, যা তাদের একটি কৌশলগত সুবিধা দেয়।
৩. বিমান বাহিনী
বিমান বাহিনী সামরিক শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
চীন:
- চীনের বিমান বাহিনী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। তাদের কাছে প্রায় ৩,০০০ এর বেশি যুদ্ধবিমান রয়েছে।
- চীনের আধুনিক যুদ্ধবিমান যেমন J-20 স্টেলথ ফাইটার এবং J-10 রয়েছে, যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত।
ভারত:
- ভারতের বিমান বাহিনীতে প্রায় ২,০০০ এর বেশি বিমান রয়েছে। ভারতের রাফালে যুদ্ধবিমান সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হওয়ায় তাদের শক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও Sukhoi Su-30MKI ভারতের অন্যতম আধুনিক যুদ্ধবিমান।
৪. নৌবাহিনী
নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে চীন আবারও ভারতের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভি (PLAN) বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে ৭০০ এরও বেশি জাহাজ রয়েছে। চীনের নৌবাহিনীতে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, ডেস্ট্রয়ার, এবং সাবমেরিনের বিশাল বহর রয়েছে।
ভারতের নৌবাহিনীও শক্তিশালী এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক। তবে, চীনের তুলনায় ভারতের জাহাজের সংখ্যা কম—ভারতের নৌবাহিনীতে প্রায় ১৫০-১৭০ যুদ্ধজাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে INS Vikramaditya এবং INS Vikrant এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার অন্যতম।
৫. প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীন উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। চীনের A.I.-নির্ভর ড্রোন, সাইবার যুদ্ধ ক্ষমতা, এবং হাইপারসনিক মিসাইল উন্নয়ন তাদের সামরিক ক্ষেত্রে একটি উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
ভারতও সামরিক প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে, বিশেষত ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (DRDO) এর মাধ্যমে। ভারতের Agni সিরিজের ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং BrahMos সুপারসনিক মিসাইল উন্নতমানের হলেও চীনের অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি ভারতের তুলনায় কিছুটা এগিয়ে।
৬. কূটনৈতিক সমর্থন এবং জোট
কোনও সংঘাতের সময় কূটনৈতিক জোট এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের ক্ষেত্রে তাদের কৌশলগত মিত্ররা যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, এবং অস্ট্রেলিয়া (যারা QUAD জোটের অংশ), সমর্থন দিতে পারে। অন্যদিকে, চীনকে সমর্থন করার জন্য তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া এবং কিছুটা উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তান রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যা তাদের আন্তর্জাতিক শক্তি বাড়াতে সাহায্য করেছে।
৭. ভূ-রাজনৈতিক চাপ এবং সামরিক কৌশল
যুদ্ধের সময় শুধু সামরিক শক্তিই সব নয়, কৌশলগত দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এবং চীনের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ এবং লাদাখে সংঘাতের সময় দেখা গেছে যে দুই দেশই সামরিক কৌশলতে বেশ দক্ষ। তবে, চীনের সৈন্য সংখ্যা এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে তাদের কৌশলগত অবস্থান কিছুটা সুবিধাজনক।
উপসংহার
ভারত ও চীনের মধ্যে সামরিক শক্তির তুলনা করলে দেখা যায়, চীন অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে এগিয়ে। তাদের সামরিক বাজেট, বাহিনীর আকার, এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তবে, ভারতের শক্তিশালী বিমান বাহিনী, আধুনিক যুদ্ধবিমান এবং কৌশলগত মিত্রদের সমর্থনও একে অস্বীকারযোগ্য শক্তি হিসেবে প্রমাণিত করেছে।
যদি কোনও সরাসরি যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তবে চীনের সামরিক শক্তি অনেক বেশি হলেও, ভারতের সামরিক কৌশল, মিত্রদের সহায়তা, এবং অভিজ্ঞতা তাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করবে।