পোশাক শিল্প উভয় ভারত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, ভারত অনেক বড় দেশ এবং এর শিল্প খাতও বৈচিত্র্যময় হওয়া সত্ত্বেও, পোশাক শিল্প বাংলাদেশের মতো তেমন দ্রুত বৃদ্ধি পায়নি। গত কয়েক দশকে, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী একটি প্রধান পোশাক উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যখন ভারত, যদিও পোশাক উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, একই স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। এই শিল্পের ভিন্ন গতিপথের পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে শ্রম খরচ, সরকারি নীতি, সরবরাহ শৃঙ্খলের দক্ষতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক, এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এই প্রবন্ধে, ভারতের পোশাক শিল্প কেন বাংলাদেশের মতো দ্রুত বৃদ্ধি পায়নি তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হবে, যেখানে প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং উভয় দেশের পোশাক খাতের গঠনগত পার্থক্যগুলি তুলে ধরা হবে।
১. শ্রম খরচ এবং কর্মশক্তির সুবিধা
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো এর কম শ্রম খরচ। বাংলাদেশে পোশাক খাতে বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি পাওয়া যায়। ২০২৩ সালের হিসাবে, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি প্রায় $৯৫ প্রতি মাসে, যেখানে ভারতে এটি অঞ্চলের ভিত্তিতে $১১০ থেকে $১৬০ এর মধ্যে থাকে। কম মজুরি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর জন্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে পরিণত করেছে।
ভারতে শ্রম খরচ বেশি, কারণ বেশ কিছু কারণে, যেমন কঠোর শ্রম আইন, মুদ্রাস্ফীতির চাপ, এবং আঞ্চলিক পার্থক্য। ভারতের শ্রম আইন অনেক কঠোর, যা শ্রমিক নিয়োগ এবং তাদের কাজ বজায় রাখার খরচ বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও, ভারতীয় পোশাক শ্রমিকরা প্রায়ই অন্য খাতে কাজ খোঁজেন যেখানে মজুরি বা কাজের শর্তাবলী আরও ভালো থাকে, যা পোশাক শিল্পের জন্য একটি কম স্থিতিশীল কর্মশক্তি সৃষ্টি করে।
২. সরকারি নীতি এবং শিল্পের দিকে মনোযোগ
সরকারি নীতির ভূমিকা শিল্পের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সরকার ঐতিহাসিকভাবে পোশাক শিল্পকে সমর্থন করে আসছে অনুকূল নীতি, প্রণোদনা, এবং রপ্তানিমুখী উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে। দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলো (EPZ) আকর্ষণীয় কর ছাড় এবং অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করেছে, যা পোশাক উৎপাদকদের তাদের কার্যক্রম বাড়াতে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশের সরকার পশ্চিমা বাজারগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষেত্রে খুবই সক্রিয় ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সঙ্গে ‘এভরিথিং বাট আর্মস (EBA)’ উদ্যোগের আওতায় দেশটি শুল্কমুক্ত প্রবেশ সুবিধা পেয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (GSP) থেকে সুবিধা পেয়েছে।
অন্যদিকে, ভারতের পোশাক শিল্প একই ধরনের লক্ষ্যভিত্তিক সমর্থন পায়নি। যদিও ভারত তার বস্ত্র ও পোশাক খাতকে উৎসাহিত করার জন্য নীতি প্রণয়ন করেছে, এই নীতিগুলো প্রায়ই সুসংহত ছিল না এবং পোশাক উৎপাদনের দিকে বাংলাদেশের তুলনায় কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ভারতের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জটিল কর কাঠামো এবং কঠোর শ্রম আইন পোশাক নির্মাতাদের ব্যবসা পরিচালনা কঠিন করে তুলেছে। ২০১৭ সালে পণ্য ও পরিষেবা কর (GST) চালু করা হয়েছিল কর ব্যবস্থাকে সরল করার জন্য, তবে এটি বস্ত্র খাতে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং বৃদ্ধিকে ধীর করে দেয়।
৩. সরবরাহ শৃঙ্খল এবং অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ
ভারতের পোশাক শিল্পের ধীরগতির আরেকটি কারণ সরবরাহ শৃঙ্খলে অদক্ষতা এবং অবকাঠামোগত সমস্যা। যদিও ভারতের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বস্ত্র শিল্প রয়েছে, যা স্পিনিং এবং বয়ন অন্তর্ভুক্ত করে, পোশাক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল সংগ্রহ, রঞ্জন, সেলাই, সমাপ্তি এবং প্যাকেজিং সহ বেশ কয়েকটি জটিল স্তর রয়েছে। প্রতিটি স্তরে মসৃণ সমন্বয় এবং লজিস্টিক্স প্রয়োজন, কিন্তু সরবরাহ শৃঙ্খলের বিভিন্ন পর্যায়ে অদক্ষতা ভারতের পোশাক উৎপাদনকে প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষ পোশাক উৎপাদন চেইন তৈরি করেছে। নিজস্ব তুলা শিল্প না থাকলেও, এটি চীন ও ভারতের মতো দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে এবং এই কাঁচামালগুলো দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত পোশাক কারখানায় প্রক্রিয়াকরণ করে। বেশিরভাগ কারখানা বন্দরের নিকটে অবস্থিত এবং দ্রুত লজিস্টিক সুবিধার কারণে রপ্তানি দ্রুত সম্পন্ন হয়। এর ফলে, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী দ্রুত ফ্যাশন সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য উৎসে পরিণত হয়েছে।
ভারতের পরিবহন এবং লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নতির দিকে থাকলেও প্রায়ই এটি অপর্যাপ্ত, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় যেখানে অনেক পোশাক কারখানা অবস্থিত। দুর্বল সড়ক সংযোগ, অপ্রতুল বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং পণ্য পরিবহনে দীর্ঘ সময় পোশাক উৎপাদনের খরচ এবং সময় বাড়িয়ে দেয়।
৪. রপ্তানিমুখীতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বৃদ্ধি মূলত রপ্তানিমুখী, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং কানাডার দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০% পোশাক খাত থেকে আসে, যা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই রপ্তানিমুখীতা পোশাক উৎপাদকদের উচ্চ মানের এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের পণ্য বজায় রাখতে প্ররোচিত করেছে, যা বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে, দেশের বাজারে চাহিদা থাকায় এটি তুলনামূলকভাবে কম রপ্তানিমুখী ছিল। যদিও ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আগ্রাসী সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। এছাড়া, ভারতের পোশাক শিল্প বৈশ্বিক বাজারে অন্যান্য দেশের যেমন বাংলাদেশের, ভিয়েতনামের, এবং চীনের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়। এ কারণেও ভারতের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের বৃদ্ধি ধীর হয়েছে।
এছাড়া, ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম সুবিধাজনক। যেখানে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশ সুবিধা ভোগ করছে, ভারতের পোশাক পণ্য আমদানি শুল্কের আওতায় পড়ে, যা মূল্যে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয়।
৫. কাঁচামালের খরচ
ভারতের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বস্ত্র শিল্প রয়েছে, যেখানে তুলা উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাঁচামালের সহজলভ্যতা রয়েছে। তবে, এই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, ভারতে কাঁচামালের খরচ প্রায়ই বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। এর কারণ হলো কৃষি সরবরাহ শৃঙ্খলে অদক্ষতা, পরিবহন খরচ, এবং কাঁচামালের ওপর শুল্ক।
বাংলাদেশ নিজস্ব তুলা উৎপাদন না করলেও, চীন এবং ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি করে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে। তারপর এই কাঁচামালগুলো দেশের পোশাক কারখানায় কম খরচে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, যা দেশের কম শ্রম খরচ এবং দক্ষ উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য সম্ভব হয়েছে। সস্তা কাঁচামালের প্রাপ্যতা এবং কম উৎপাদন খরচ বাংলাদেশের পোশাকগুলিকে ভারতের তুলনায় কম দামে সরবরাহ করতে সক্ষম করেছে।
৬. মান এবং সম্মতি মানদণ্ড
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী নৈতিকভাবে উত্পাদিত এবং টেকসই ফ্যাশনের চাহিদা বেড়েছে। এর ফলে, কারখানার কাজের পরিবেশ, মজুরির স্তর এবং পরিবেশগত চর্চাগুলোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। যদিও ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়েই শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং কারখানার শর্তাবলী নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সহায়তায়, কারখানার নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের কাজের শর্তাবলী উন্নত করতে কঠোর মানদণ্ড অনুসরণ করছে, যা গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাংলাদেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে। অন্যদিকে, ভারতের পোশাক শিল্পে একই ধরনের মানদণ্ড কার্যকর করা অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়েছে।
৯. উপসংহার
ভারত এবং বাংলাদেশের পোশাক শিল্প উভয়ই তাদের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তাদের বৃদ্ধির গতিপথ আলাদা। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সাফল্যের মূল কারণ হলো কম শ্রম খরচ, সরকারি সমর্থন, দক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খল, রপ্তানিমুখীতা, এবং মানদণ্ড বজায় রাখা। অন্যদিকে, ভারতের পোশাক শিল্প উচ্চ শ্রম খরচ, জটিল নিয়মাবলি, অবকাঠামোগত সমস্যা, এবং দেশের বাজারে বেশি মনোযোগ দেওয়ার কারণে পিছিয়ে রয়েছে।
ভারতকে তার পোশাক শিল্পে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে হলে এই চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে হবে, বিশেষ করে সরকারি নীতিগুলোর সমন্বয়, সরবরাহ শৃঙ্খলের উন্নতি, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হওয়া প্রয়োজন।