ভূমিকা
দক্ষিণ এশিয়া, যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রভাবাধীন একটি অঞ্চলে হিসেবে পরিচিত ছিল, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে। চীন তার অর্থনৈতিক শক্তি এবং কৌশলগত উদ্যোগের মাধ্যমে এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারত, যার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অনেকদিন ধরে ছিল, এখন সেই সম্পর্কগুলোর অবনতির মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই দাবি করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ‘বন্ধুহীন’ হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি কেন এবং কিভাবে তৈরি হলো তা বোঝার জন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, চীনের প্রভাব, এবং ভারতের বর্তমান কূটনৈতিক নীতিগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
ভারতের দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহাসিক প্রভাব
ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে আঞ্চলিক শক্তি এবং কৌশলগত নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ভারত শুধু তার বিশাল ভূখণ্ড বা জনসংখ্যার কারণে নয়, বরং তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতার কারণেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল। ভারতের কূটনৈতিক নীতিগুলো মূলত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর নির্ভরশীল ছিল।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, এবং ভুটানের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বরাবরই সমস্যাপূর্ণ হলেও, ভারত তার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর মাধ্যমে ভারত এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সহযোগিতাকে প্রমোট করেছিল।
সাম্প্রতিক সংকটের কারণ
তবে, গত দশক ধরে ভারতের এই আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। বিভিন্ন কারণে এই পরিবর্তন হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভারতের কূটনৈতিক কৌশলে ভুল পদক্ষেপ, চীনের কৌশলগত অবস্থান বৃদ্ধি, এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।
১. প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি
ভারতের সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
নেপাল
ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে। ২০১৫ সালে নেপালের সংবিধান প্রণয়নের সময় ভারত সরকারের কিছু মন্তব্য এবং পদক্ষেপকে নেপাল অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছে। এর পাশাপাশি, নেপালের দক্ষিণাঞ্চলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাধেসি সম্প্রদায়ের আন্দোলনের সময় ভারত নেপালে পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দেয়, যা নেপালে জ্বালানি সংকট তৈরি করে এবং ভারতবিরোধী মনোভাবকে উস্কে দেয়। ২০২০ সালে নেপাল-ভারত সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা বাড়ে, যখন নেপাল ভারতের নতুন মানচিত্রে দাবি করা কিছু অঞ্চলের ওপর নিজেদের মালিকানা দাবি করে। নেপাল সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ এবং ভারতের সাথে সীমান্ত বিরোধ উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে মজবুত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে কিছু ফাটল দেখা দিয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (NRC)-এর মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের কিছু নীতির বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করা হয়, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে। এর পাশাপাশি, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে, যা ভারতের প্রতি বাংলাদেশের অসন্তোষের আরেকটি কারণ।
শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করেছে, যা ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কায় চীনের বিশাল অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং বন্দর ব্যবস্থাপনা চুক্তি ভারতের কৌশলগত স্বার্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব এই সম্পর্কের উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা নির্দেশ করে।
পাকিস্তান
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা আরও খারাপ হয়েছে। কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত সংঘর্ষ, এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই তিক্ত। ভারতের ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে।
২. চীনের প্রভাব বৃদ্ধি
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং বিশাল অবকাঠামো বিনিয়োগের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চীনের এই অর্থনৈতিক কৌশল ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল এবং পাকিস্তান চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি করেছে, যা ভারতের অবস্থানকে দুর্বল করে তুলেছে।
শ্রীলঙ্কায় চীনের প্রভাব
শ্রীলঙ্কায় চীনের বিশাল বিনিয়োগ এবং হ্যাম্বানটোটা বন্দরের ব্যবস্থাপনা চুক্তি চীনের দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। এই বন্দরটি চীনের সামরিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবকে আরও বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে। শ্রীলঙ্কায় চীনের এই প্রভাব ভারতীয় স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে দেখা হয়, কারণ এটি ভারত মহাসাগরে চীনের কৌশলগত উপস্থিতিকে শক্তিশালী করেছে।
নেপাল এবং বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
নেপাল এবং বাংলাদেশও চীনের কাছ থেকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়ে চলেছে। নেপাল চীনের BRI-এর অংশ হিসেবে তার অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক চুক্তি করেছে। বাংলাদেশও চীনের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এইসব চুক্তি এবং সম্পর্ক ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবকে হ্রাস করছে এবং চীনের প্রভাবকে আরও জোরালো করছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক
পাকিস্তান চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) এর মাধ্যমে চীন পাকিস্তানে বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা চীনের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের এই সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে, যা ভারতের জন্য কৌশলগত উদ্বেগের কারণ।
ভারতের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং কৌশলগত পরিবর্তনের প্রয়োজন
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব যে ক্রমশ কমছে তা স্পষ্ট। ভারতের জন্য এটি একটি সংকেত যে তার কূটনৈতিক কৌশলে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ভারতের বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকে নজর দিতে হবে।
১. কূটনৈতিক পুনর্মূল্যায়ন
ভারতের কূটনৈতিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে। নেপাল, বাংলাদেশ, এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারতের জন্য নতুন কৌশল প্রণয়ন করা জরুরি।
২. চীনের প্রভাবের মোকাবিলা
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় ভারতকে আরও কৌশলগতভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। ভারতের উচিত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বাণিজ্য চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা করা, যাতে তারা চীনের দিকে না ঝুঁকে পড়ে। অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানো যেতে পারে।
৩. সাংস্কৃতিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক
ভারতের উচিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করা। আঞ্চলিক স্তরে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, এবং কৌশলগত সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্কগুলো পুনরায় মজবুত করা যেতে পারে।
৪. আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি
সার্ক এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনের মাধ্যমে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে পারে। সার্ক-এর কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ভারতকে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে এই অঞ্চলের দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে।
উপসংহার
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ‘বন্ধুহীন’ হওয়ার ধারণাটি একটি গুরুতর সংকেত। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে, ভারত যদি তার কূটনৈতিক কৌশলগুলো পুনর্বিবেচনা করে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করে, তবে সে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।