দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক শক্তিতে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যদিও তাদের সামরিক ক্ষমতা ও সম্পদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সামরিক বাহিনী। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও আকারে ছোট হলেও একটি শক্তিশালী, কার্যকর এবং উন্নতমানের বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছে। উভয় সেনাবাহিনী নিজ নিজ দেশের প্রতিরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মিশনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
এই প্রবন্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রধান প্রধান পার্থক্য, সক্ষমতা, সরঞ্জাম এবং শক্তি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে।
১. সেনাবাহিনীর আকার
ভারতীয় সেনাবাহিনী

ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্থল বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এটি প্রায় ১৩ লক্ষ সক্রিয় সৈন্য নিয়ে গঠিত, যার সঙ্গে রয়েছে প্রায় ১১ লক্ষ রিজার্ভ বাহিনী। ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে বিশাল বাজেট রয়েছে, যা সেনাবাহিনীর শক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
- সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা: ১৩ লক্ষ
- রিজার্ভ সৈন্য সংখ্যা: ১১ লক্ষ
- বাজেট: প্রায় $৮৩ বিলিয়ন (২০২৪)
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আকার তুলনামূলকভাবে ছোট, তবে এটি একটি উচ্চ প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ বাহিনী হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রায় ২ লক্ষ সক্রিয় সৈন্য নিয়ে গঠিত এবং আরও কয়েক লক্ষ রিজার্ভ সদস্য রয়েছে।
- সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা: প্রায় ২ লক্ষ
- রিজার্ভ সৈন্য সংখ্যা: প্রায় ৬৫,০০০
- বাজেট: প্রায় $৪ বিলিয়ন (২০২৪)
২. ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান
ভারতীয় সেনাবাহিনী
ভারতীয় সেনাবাহিনী বিভিন্ন উন্নত মানের ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়ান এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বেশ কয়েকটি ট্যাংক। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান যুদ্ধ ট্যাংকগুলো হলো:
- T-90S Bhishma: ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান ট্যাংক। এটি রাশিয়ান প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি এবং ভারতে উন্নত করা হয়েছে।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ৫ কিমি পর্যন্ত
- সাঁজোয়া সুরক্ষা: উচ্চমানের
- গতি: ৬০ কিমি/ঘণ্টা
- Arjun MBT: ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ৪ কিমি পর্যন্ত
- গতি: ৭০ কিমি/ঘণ্টা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানত চীন এবং অন্যান্য দেশের তৈরি ট্যাংক ব্যবহার করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ট্যাংকগুলো হলো:
- MBT-2000: চীনের তৈরি এবং বাংলাদেশের প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ৪ কিমি পর্যন্ত
- গতি: ৭৫ কিমি/ঘণ্টা
- Type 69-II: পুরোনো কিন্তু এখনো সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত ট্যাংক।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ২ কিমি পর্যন্ত
৩. গোলন্দাজ বাহিনী
ভারতীয় সেনাবাহিনী
ভারতীয় সেনাবাহিনী আধুনিক গোলন্দাজ সরঞ্জামের মাধ্যমে সজ্জিত, যা দেশটির সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। প্রধান গোলন্দাজ সরঞ্জামগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- Bofors FH-77: ১৫৫ মিমি হাউইটজার যা দীর্ঘ পাল্লার গোলাবর্ষণে ব্যবহৃত হয়।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ৩০ কিমি
- Pinaka Multi Barrel Rocket Launcher (MBRL): ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি একটি রকেট লঞ্চার সিস্টেম।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ৪০ কিমি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও গোলন্দাজ সরঞ্জামে উন্নতমানের হয়ে উঠেছে। প্রধান গোলন্দাজ সরঞ্জামগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- NORINCO SH-1: ১৫৫ মিমি স্বয়ংক্রিয় হাউইটজার।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ৫০ কিমি
- Type 59 হাউইটজার: ১৩০ মিমি ক্যালিবারের হাউইটজার, যা দীর্ঘ-পাল্লার গোলাবর্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ফায়ারিং রেঞ্জ: ২৭ কিমি
৪. বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
ভারতীয় সেনাবাহিনী
ভারতীয় সেনাবাহিনী উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে। প্রধান বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- S-400 Triumph: রাশিয়ার তৈরি দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা শত্রুদের মিসাইল ও বিমান প্রতিরোধে সক্ষম।
- রেঞ্জ: ৪০০ কিমি পর্যন্ত
- Akash Missile System: ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি একটি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
- রেঞ্জ: ২৫ কিমি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য নিম্ন ও মাঝারি-পাল্লার মিসাইল ব্যবহার করে। প্রধান সরঞ্জামগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- FM-90 Missile System: চীনের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা যা স্বল্প-পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- রেঞ্জ: ১৫ কিমি
- KS-1M Missile System: মাঝারি-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যা শত্রুদের বিমান প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।
- রেঞ্জ: ৫০ কিমি
৫. ড্রোন প্রযুক্তি
ভারতীয় সেনাবাহিনী
ভারত ড্রোন প্রযুক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের ড্রোন পরিচালনা করে। প্রধান ড্রোনগুলো হলো:
- Heron UAV: ইসরায়েলি প্রযুক্তির একটি ড্রোন যা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ফ্লাইট রেঞ্জ: ৫০০ কিমি
- Rustom UAV: ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রোন।
- ফ্লাইট সময়: ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ড্রোন প্রযুক্তিতে উন্নয়ন করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের ড্রোন ব্যবহার করছে। প্রধান ড্রোনগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- CH-4B Drone: চীনের তৈরি একটি আক্রমণাত্মক ও নজরদারি ড্রোন।
- ফ্লাইট রেঞ্জ: ৩০০০ কিমি
- Bayraktar TB2: তুরস্কের তৈরি ড্রোন যা সামরিক অভিযানে ব্যবহৃত হয়।
- ফ্লাইট সময়: ২৪ ঘণ্টা
৬. বিশেষ বাহিনী
ভারতীয় সেনাবাহিনী
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনী (Para SF) দক্ষতা এবং কৌশলের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তারা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অপারেশন এবং গোপন মিশনে কাজ করে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ব্রিগেডও দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত। তারা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অপারেশন এবং গোপন মিশন পরিচালনা করে।
উপসংহার
ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় সেনাবাহিনীই দক্ষ, যদিও তাদের আকার এবং সামরিক বাজেটে পার্থক্য রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আকারে বড়, অধিকতর সরঞ্জাম সমৃদ্ধ এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও তাদের কৌশলগত সক্ষমতা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বেশ উন্নত।